হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ইমাম মুহাম্মাদ বাকির (আ.) বলেছেন:
"আল্লাহ সেই বান্দার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন, যে জ্ঞানকে জীবিত রাখে।"
আবু আল-জারূদ ইমামের কাছে জিজ্ঞাস করলেন: “জ্ঞানকে জীবিত রাখা বলতে কী বোঝানো হয়েছে?”
ইমাম (আ.) বললেন:
“জ্ঞানী ও পরহেযগারদের(ধার্মিক, সৎ, পাপ থেকে বিরত থাকা ব্যক্তি, কিংবা আত্মসংযমী) ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করাই জ্ঞানকে জীবিত রাখা।”
উৎস: আল-কাফি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪১।
ভূমিকা:
ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু আলোকিত ব্যক্তিত্বের নাম চিরভাসমান হয়ে আছে, যাঁদের জীবনী কেবল একটি বিশেষ সময়ের নয়, বরং সর্বকালের জন্যই পথপ্রদর্শক। তাঁদের জীবনচরিত কেবল স্মরণীয়ই নয়—অনুসরণীয়। তেমনই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন ইমাম মুহাম্মাদ আল-বাকির (আ.)। যিনি জ্ঞানের সমুদ্রের এক দীপ্ত শিখা হিসেবে সমগ্র মানবজাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছেন।তিনি এমন এক যুগে আবির্ভূত হন, যখন সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য মুছে যেতে বসেছিল, মানুষ দ্বিধা ও বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত ছিল। ঠিক তখনই তিনি জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও আত্মিক গভীরতার মাধ্যমে গড়ে তোলেন এক নিঃশব্দ বিপ্লব—যা আজও ইসলামী চিন্তাধারায় মৌলিক ও অপরিহার্য ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়:
ইমাম মুহাম্মাদ আল-বাকির (আ:) ইসলামের পঞ্চম ইমাম। তিনি ৫৭ হিজরিতে (৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে) ১ লা রজব মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হলেন চতুর্থ ইমাম, ইমাম আলী ইবনে হুসাইন যাইনুল আবেদীন (আ.) এবং মাতার নাম ছিল ফাতিমা বিনতে হাসান (সদ্দিকা)। তিনি ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.) উভয়ের বংশধর, যা তাঁকে একমাত্র ব্যক্তি করে তোলে যিনি উভয় ইমামের রক্তধারা বহন করেন।
উপাধি ও খ্যাতি:
ইমাম বাকির (আ.)-এর সবচেয়ে বিখ্যাত উপাধি হলো "বাকিরুল উলূম" অর্থাৎ "জ্ঞানসমূহের উৎঘাটক"। মহানবী (সা.) নিজেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন:
"তুমি তাঁকে দেখবে যিনি আমার বংশধর, তিনি হবে মুহাম্মাদ ইবনে আলী, এবং তিনি হবে জ্ঞানসমূহের উৎঘাটক (বাকিরুল উলুম)।"
(সুন্নি ও শিয়া উভয় হাদীসগ্রন্থে বর্ণিত)
বাকিরুল উলূম বা বাকির (অর্থ: জ্ঞানের উন্মোচনকারী বা গভীরভাবে বিশ্লেষণকারী) ইমাম মুহাম্মাদ বাকির (আ.)-এর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ উপাধি।
কিতাব ‘ইলালুশ শরায়়ে’-এ জাবির ইবনে ইয়াযিদ জুআফি থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো ইমাম পঞ্চমকে “বাকির” কেন বলা হয়? তখন তিনি বললেন: কারণ, তিনি প্রকৃত অর্থে জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করেছেন ও তা উন্মোচন করেছেন।
যেমনটি ‘ওসিলাতুল খাদিম’ নামক কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা লিখেছেন ফাযল ইবনে রুজবেহান যিনি ছিলেন নবম ও দশম হিজরী শতাব্দীর একজন সুন্নি আলেম । সেখানে এসেছে যে, মহানবী (সা.) ইমাম পঞ্চমকে এই “বাকির” উপাধিতে নামকরণ করেছিলেন।
এছাড়াও ইমাম সাদিক (আ.)-এর একটি বর্ণনায় এসেছে যে, মহানবী (সা.) “বাকির” উপাধিকে একটি বিশেষ ফজিলতেরূপে ইমাম বাকির (আ.)-কে প্রদান করেছেন।
মহানবী (সা.) জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারিকে এ ওয়াদা দিয়েছিলেন যে: তুমি এতদিন বেঁচে থাকবে যে আমার সন্তান “মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবি তালিব”-এর সাক্ষাৎ পাবে, যাকে তাওরাতে “বাকির” নামে ডাকা হয়েছে। এবং যখন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, তখন আমার সালাম তাকে পৌঁছে দিও।
ইমাম রেযা (আ.)-এর একটি বর্ণনা অনুযায়ী, তাওরাতে ইমাম বাকির (আ.)-এর নাম “মাসহূর” হিসেবে উল্লেখ রয়েছে।
আরও একটি বর্ণনা অনুযায়ী, যা কিতাব ‘তাযকিরাতুল খাওয়াস’-এ এসেছে, যা লিখেছেন সাবিত ইবনে জাওযি (ওফাত: ৬৫৪ হিজরী), সেখানে বলা হয়েছে ইমাম (আ.)-কে “বাকির” বলা হয় এই কারণে যে, তিনি অধিক সেজদা করতেন এবং এর ফলে তাঁর কপালে গর্ত সৃষ্টি হয়েছিল।
ইমাম বাকির (আ.) এমন এক যুগে জীবনযাপন করেছেন যখন উমাইয়া শাসকদের অত্যাচার চরমে পৌঁছেছিল, আর মানুষ ধর্মীয় বিভ্রান্তি ও অজ্ঞতার অন্ধকারে ছিল। এই সময়ে তিনি একটি বিপ্লব ঘটান, তবে সেটা ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক ও জ্ঞানগত বিপ্লব। তিনি হাজার হাজার মানুষকে ধর্মীয় জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা শিক্ষা দেন।
ইমাম বাকির (আ.)-এর জীবন ও অবদান:
ইমাম (আ.) একাধারে ছিলেন আলেম, দার্শনিক, মুফাস্সির ও হাদীস বিশারদ। তিনি হাজার হাজার হাদীস শিক্ষাদান করেছেন, ফিকহ, তাফসীর, আখলাক, তাওহীদসহ ইসলামি জ্ঞানের প্রায় প্রতিটি শাখায় মৌলিক অবদান রেখেছেন।
তাঁর ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন:
১. মুহাম্মাদ ইবনে মুসলিম
২. জাবির ইবনে ইয়াযিদ জুফি
৩. হিশাম ইবনে সালিম
৪. আবু বাসির লায়থ ইবনে বুখতুরি
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) যিনি পরবর্তী ইমাম।
ইমাম বাকির (আ.) শিয়া ফিকহ এবং হাদীস শাস্ত্রের মৌলিক ভিত্তি রচনা করেন, যেখান থেকে ইমাম সাদিক (আ.) পরে একটি বিস্তৃত ইসলামি জ্ঞানের স্কুল গড়ে তোলেন।
শাহাদাত:
ইমাম বাকির (আ.)-কে বিষ প্রয়োগ করে শহীদ করা হয়েছিল। উমাইয়া খলিফা হিশাম ইবনে আবদুল মালিক তাঁর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ও জ্ঞান প্রচার দেখে আতঙ্কিত হয়ে তাঁকে শহীদ করার ষড়যন্ত্র করে। তিনি ১১৪ হিজরিতে (৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে) ৭ই জিলহজ শহীদ হন এবং মদিনার জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে সমাহিত হন।
ইমাম (আ.)-এর কিছু বিখ্যাত উক্তি:
১. "জ্ঞানার্জন করা সকল মুসলমানের উপর ফরজ।"
২. "তিনটি জিনিস যাকে ধ্বংস করে: অহংকার, লোভ এবং হিংসা।"
৩. "যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের জন্য যা চায়, তা নিজের জন্যও চায় না, সে প্রকৃত মুমিন নয়।"
ইমাম বাকির (আ.)-এর জীবন থেকে শিক্ষা:
১. জ্ঞানকে শ্রেষ্ঠ অস্ত্র হিসেবে দেখা:
ইমাম (আ.) দেখিয়েছেন, ইসলামকে রক্ষা করার সবচেয়ে শক্তিশালী উপায় হলো জ্ঞানচর্চা। আজ আমাদের জন্যও শিক্ষণীয়,কেবল আবেগ দিয়ে নয়, যুক্তি ও জ্ঞান দিয়েও ইসলামকে তুলে ধরা জরুরি।
২. সত্য প্রতিষ্ঠায় ধৈর্য ও স্থিরতা:
ইমাম (আ.)-এর জীবনে রয়েছে ধৈর্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক চাপ, অত্যাচার সত্ত্বেও তিনি নিজের পথ থেকে বিচ্যুত হননি।
৩. নীরব বিপ্লবের কৌশল:
ইমাম (আ.) সরাসরি যুদ্ধ বা বিদ্রোহ না করে এক নীরব জ্ঞান-আন্দোলনের মাধ্যমে ইসলামের শুদ্ধ শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠা করেন।
৪. নৈতিকতা ও আত্মশুদ্ধি:
ইমাম (আ.) শিক্ষা দেন যত বড় আলেমই হোন না কেন, নৈতিকতা ও আত্মশুদ্ধিই একজন মুসলমানের প্রকৃত পরিচয়।
উপসংহার:
ইমাম মুহাম্মাদ আল-বাকির (আ.) আমাদের সামনে যে আলো জ্বালিয়েছেন, তা আজও আমাদের পথ প্রদর্শন করে। তাঁর জীবনী থেকে আমরা শিখি—কিভাবে জ্ঞান, ধৈর্য, ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সত্য ও ন্যায়ের পথকে অনুসরণ করা যায়।
আজকের মুসলিম সমাজের উচিত তাঁর জীবনাদর্শ ও জ্ঞানভিত্তিক আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আলোকিত সমাজ গঠন করা।
লেখক: কবির আলী তরফদার কুম্মী।
তারিখ: ০৩/০৬/২০২৫
আপনার কমেন্ট